অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে সিলেট জেলার ৩০ লাখ ও সুনামগঞ্জ জেলার ২০ লাখ লোক কঠিন সময় পার করছেন। এটি চলতি মৌসুমের তৃতীয় দফা বন্যা। পরিস্থিতি ভয়াবহতা এতটাই বেশি যে, সামাল দিতে সিভিল প্রশাসনের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে নামাতে হয়েছে৷
এবারের বন্যা এত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রেল স্টেশন, এয়ারপোর্ট সবই বন্ধ করে দিতে হয়েছে৷ পুরো সিলেট শহর এখন পানির নিচে৷ বন্যার পানির কারণে সিলেট রেলস্টেশন থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আর বিদ্যুৎ না থাকায় বন্যার পানিতে ডুবে থাকা সুনামগঞ্জ এখনো অন্ধকারে রয়েছে। এদিকে পানি প্রবেশ করায় গতকাল শনিবার বেলা ১১টার দিকে কুমারগাঁও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটি নিরাপত্তার স্বার্থে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে সিলেটে বিদ্যুত্সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদিও পানি নিষ্কাশন করে উপকেন্দ্রটি চালু করা হলে সন্ধ্যা ৭টার দিকে সিলেটের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়। সেখানে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, গো-খাদ্য ও জ্বালানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবির উদ্ধার তত্পরতা চলছে।
স্থানীয়রা বলছেন, ভারি বর্ষণ আর উজানের ঢলে সুরমা-কুশিয়ারার পানি অনবরত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বেশি প্লাবিত হয়েছে সিলেটের সীমান্তবর্তী অঞ্চল কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট এলাকার বিস্তীর্ণ জনপদ। বানের জলে ভেসে যাচ্ছে কাঁচা ও টিনশেড বাড়িঘর। অনেক জায়গায় নদী ভাঙনও দেখা দিয়েছে। এরইমধ্যে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এমন অবস্থায় সরকারি সহায়তাও পোঁছাচ্ছে না মানুষের কাছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেটের সিনিয়র আবহাওয়াবিধ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, পুরো জুন মাসে ৮১৮ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু ১৬ তারিখ পর্যন্ত ৯৪ দশমিক ৮১ শতাংশ অর্থাৎ ৭৭৪ দশমিক ৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে গেছে। আগামী ২৬ জুন পর্য সিলেটে ভারি বর্ষণ হবে। তাতে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের মেঘালয় ও আসামে বৃষ্টি হলে বাংলাদেশে উজান থেকে পানি আসা বন্ধ হবে না৷ সিলেট বিভাগের বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির আশা নেই৷ দেশের উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি আগামী দুই দিনের মধ্যে আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে৷ বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ বলছে, সিলেট বিভাগের বন্যা এর আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে৷ উজান থেকে আসা ঢলে এই বিভাগের বেশির ভাগ এলাকা এখন পানির নিচে৷ সুনামগঞ্জে বিদ্যুৎ নেই, সুপেয় পানি নেই, মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নেই৷ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে৷
হাওরে অবকাঠামো নির্মাণ, নদীর তলদেশ পলিমাটিতে ভরে যাওয়া, অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলন, পুকুর-খাল ময়লা আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাওয়াকে এ ভয়াবহ দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
পানি গবেষণা ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ‘‘এবারের এইরকম আকস্মিক বন্যার পিছনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ৷ ’’
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপ্রবণ এলাকার একটি চেরাপুঞ্জিসহ ভারতের আসাম মেঘালয়ে গত তিন দিনে প্রায় ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টি হয়েছে, যা গত ২৭ বছরের মধ্যে তিন দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড।
আবহাওয়া অফিস থেকে জানানো হয়েছে, সিলেট সংলগ্ন মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৯৭২ মিলিমিটার। একই রাজ্যের শিলংয়ে ১০১, আসামের গৌহাটিতে ৪২ আর ধুব্রিতে ৯৯ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। চেরাপুঞ্জিতে বৃহস্পতিবার বৃষ্টি হয়েছে ৬৭৪ মিলিমিটার।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘‘সিলেট বিভাগে বন্যা এতটা তীব্রতা পাওয়ার কারণ, পানি নামতে বাধা পাচ্ছে৷ হাওরে নানা অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে৷ এটা পানি প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করছে৷ কারণ এই অঞ্চলের পানি হাওর হয়ে নদী দিয়ে নেমে যায়। শুধু এই অবকাঠামো নয়, পাশাপাশি নদী নাব্যতা হারিয়েছে। এতে পানি দ্রুত সরতে পারছে না৷’’
এ বিষয়ে পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মত, চারটি কারণে এবার ভয়াবহ বন্যায় নাকাল অবস্থা সিলেটের। সেগুলো হলো – নদীর নাব্যতা–সংকট, হাওরে অপরিকল্পিত বাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণ, হাওর বিল ঝিল ভরাট, নির্বিচারে পাহাড়-টিলা কাটা।
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কারণে ‘‘সকল শিক্ষা বোর্ডের এসএসসি জেনারেল, এসএসসি ভোকেশনাল এবং দাখিল পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে৷ পরীক্ষার পরিবর্তিত সময়সূচি পরে জানানো হবে৷’’ করোনা মহামারির কারণে পিছিয়ে যাওয়া এসএসসি ও সমমানের লিখিত পরীক্ষা ১৯ জুন শুরু করে ৬ জুলাই শেষ করার কথা ছিল৷ কিন্তু বন্যার কারণে আবারও পিছিয়ে গেল পরীক্ষা৷